শিউলির মালা

[বাবা বিশ্ববন্ধু দাসের লেখা জীবনস্মৃতি]

স্মৃতির অতলে ডুব দিলে কতই ঘটনা। কিছু মনকে আনন্দ দেয়, আবার কিছু ব্যথিত করে। বয়সের ধর্মেই কখনও আনমনে সে সব টুকরো স্মৃতি নিয়ে চলে রোমন্থন।

আমাদের উদ্বাস্তু পরিবারে আমার দাদা-দিদির মতো আমাকে বিশেষ ঠাঁই নড়া হতে হয় নি। শুনেছি আমার যখন আনুমানিক ছয় মাস বয়স তখন থেকেই আমাদের এই নাকতলার উদ্বাস্তু কলোনীতে বসবাস। পূর্ববঙ্গের বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের জন্যই পার্শবর্তী আরও কিছু উদ্বাস্তু এলাকার মতোই এই সরকারী কলোনী — নাকতলা। এলাকার মাঝ বরাবর চলে গিয়েছে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু রোড, প্রায় প্রায় পুব-পশ্চিমে। তখন সে রাস্তা মাত্র ফুট দশেক চওড়া, দুদিকে সারিবদ্ধ গাছ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে মাঝ রাস্তার বেশ কিছু উপরে এপার-ওপারের সংস্পর্শে এসেছে। সকালের রোদে কালো পিচ ঢালা রাস্তায় আলোছায়ার আঁকিবুকি। রাস্তায় গোনাগুনতি যানবাহন। রাস্তার দক্ষিণ দিকে ছোট ছোট জমিতে খুবই সাধারণ বাড়ি নিয়ে আমাদের উদ্বাস্তু কলোনী। বিপরীতে, রাস্তার উত্তর বরাবর ব্যক্তিগত মালিকানায় অবস্থাপন্নদের বাস। তাঁদের বাড়ি বেশ বড়, অনেকটা জমি নিয়ে, প্রতিটি বাড়ির সামনে অনেকটা খোলা জায়গা, ঢুকতে হয় বড় লোহার সদর দরজা পার হয়ে। ও সব বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে এ পারের কলোনীর জমির লোকেদের মেলামেশা নেই বললেই চলে। তবুও আমাদের কাছে ওদের পরিচয়জ্ঞাপক কিছু শব্দ ছিলো — ভোলার বাগান, ব্যানার্জী বাড়ি, মিত্র বাড়ি ইত্যাদি। (বর্তমানে একটি বাড়িরও অস্তিত্ব নেই, সুন্দর বাড়িগুলি একে একে ভেঙে, জমি খণ্ডিত আর হস্তান্তরিত হতে হতে অবশেষে তাদের ঠাঁই হয়েছে আমাদের মতো পুরোনো কিছু অধিবাসীর স্মৃতিতে।)

কলোনীতে আমাদের ছোট্ট বাড়িটার প্রায় বিপরীতে ছিল ভোলার বাগান, তার পূবদিকে ব্যানার্জী বাড়ি। ব্যানার্জী বাড়িতে নানারকমের ফল আর ফুলের গাছ। আর ছিল বেশ বড়সড় এক পাখির খাঁচা — সিমেন্টের মেঝেতে লোহার স্তম্ভ দিয়ে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। মূল বাড়ির বামদিকে জমির প্রান্তে সারি সারি একতলা কুঠুরি — পরিচারক-পরিচারিকাদের বসবাসের নিমিত্ত। পুরো জমির চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ব্যানার্জী বাড়িতে ঢুকতে হতো লোহার বড় গেট পার হয়ে। গেটের পাশেই দারোয়ানের দোতলা ঘর। ছোটবেলায় আমার স্বাধীন চলাফেরার পরিধি ভোলার বাগান, ব্যানার্জী বাড়ি, মিত্রবাড়ি অতিক্রম করতো না।

বাড়িতে আমার চার দাদা, এক দিদি। আমি সকলের ছোট। পাশের বাড়িতে বাসন্তীদি, আমার দিদির বন্ধু এবং পুতুল খেলার সঙ্গী। দিদি আর বাসন্তীদির পুতুলের প্রায়ই বিয়ে হতো। বিয়ের পর বৌ দু’একদিনের জন্য শ্বশুরবাড়িতেও যেত। পুতুলের বিয়ে, বাড়িতে ঠাকুরের পূজো এবং আসন সজ্জার জন্য বা অন্য অনেক অনুষ্ঠানের জন্য দিদিকে দেখতাম খুব ভোরে বন্ধুদের সঙ্গে ফুল তুলতে যাচ্ছে। সে ফুল দিয়ে খানিক পরে বন্ধুরা একসঙ্গে বসে একাগ্রমনে মালা গাঁথতো। আমি পাশে বসে দেখতাম। অনুভব করতাম মালা গাঁথবার সময়ে সকলের ভক্তিভাব। এই আসরে ছিল এক গোপন প্রতিযোগিতা — কার সংগ্রহে কত পরিমানের, কত কিসিমের আর কত টাটকা ফুল। মালা গাঁথার আসরে আমার জায়গা হলেও ফুল তুলবার দলে বিবেচিত হতাম না।

শরৎ কাল। শিউলি ফুটতে শুরু করেছে। সাদা ধবধবে পাপড়ি, আর গেরুয়া বৃন্ত। সাজিতে যখন থাকে বা পূজোর আসনে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সাদা-গেরুয়া মিলে এক পবিত্র দৃশ্য। শরতে অন্য ফুলের তুলনায় শিউলিরই কদর বেশী।

একদিন আমার খুব ইচ্ছা হল দিদিদের সঙ্গে ফুল তুলতে যাওয়ার। দিদির কাছে নাছোড় আব্দার জানালাম পরদিনই ভোরবেলায় আমাকেও সঙ্গী করতে হবে। আমি সঙ্গে থাকলে দিদির সাজিতে ফুলের পরিমান বাড়বে ভেবেই হয়তো দিদি রাজি হয়ে গেল।

শরতের প্রত্যুষ। আসন্ন পুজোর বার্তা দিতে বাতাস বেশ হিমেল। অত ভোরে ঘুম থেকে ওঠা আমার অভ্যাস নয়। চারদিকে হাল্কা কুয়াশায় আচ্ছন্ন। মৌন। ছাইরঙা ভোর। আমার মনটা খুবই প্রসন্ন। এক হাতে ফুলের সাজি, চোখে তখনও ঘুমের রেশ, দিদির সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হলাম।

দিদি আমাকে নিয়ে চললো ব্যানার্জী বাড়ির দিকে। গাড়ির রাস্তাটা পার হলাম। দেখলাম দিদি ব্যানার্জী বাড়িতে ঢুকবার লোহার দরজাটার দিকে না গিয়ে একপাশের কাঁটাতারের বেড়া বরাবর হাঁটছে। এক জায়গায় দেখলাম বেড়ায় একটু ফোকর। দিদি আমাকে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সেই ফোকর পার হয়ে ভিতরে ঢুকেই ঠোঁট আর আঙুলের ইশারায় আমাকে সতর্ক হতে জানালো। কেন এত সতর্কতা? কেন মূল ফটক ব্যবহার না করে ফোকর দিয়ে ভিতরে আসা — বুঝতে পারছি না। দিদি আমাকে নিয়ে চললো বড় এক শিউলি গাছের নীচে। ব্যানার্জী বাড়ি তখনও নিদ্রামগ্ন। গাছের নীচে শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের উপর সাদা হয়ে রয়েছে ঝরে পড়া শিউলি। উবু হয়ে দিদির পাশে বসে কুড়িয়ে নিচ্ছি ফুল। ধীরে ধীরে আমাদের সাজি ফুলে ভরে উঠছে। ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড উত্তেজিত হলেও আমার বা দিদির কারও মুখে কোন কথা নেই। দুজনের হাতই ফুল কুড়োতে ব্যস্ত। একবার দিদি আরও ফুলের আশায় গাছটাকে সজোরে এক নাড়া দিলো। আরও একপশলা টাটকা, সাদা শিউলি ঝরে পড়লো। কিন্তু সেই সঙ্গে কানে এলো দারোয়ানের ঘরের দিক থেকে এক বাঁজখাই হুঙ্কার। আর দেখতে না দেখতেই কুয়াশা ভেদ করে তেড়ে এলো লোকটা। আমাকে একহাতে সজোরে টান দিয়ে দিদি বললো — পালা। দৃশ্যপটের এমন আচমকা পরিবর্তনের জন্য আমার মন একেবারেই তৈরী ছিল না। শিউলি ফুল কুড়োতে এসে এমনভাবে পালাতে যাব কেন? সাজি হাতে নিয়ে কয়েক কদম দৌড়ে দিদি এগিয়ে গেছে। আমিও অগত্যা লাগালাম দৌড়। আবার সেই কাঁটাতারের ফোকর গলে বাইরে। উর্দ্ধশ্বাসে পলায়নপর আমি ও দিদি ভোরবেলার শান্ত, মৌন, স্নিগ্ধ পরিবেশের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।

সেদিন দুপুরেও অন্যদিনের মত দিদি আর ওর বন্ধুদের মালা গাঁথবার আসর বসলো। শিউলির মালা নিয়ে সুন্দর করে ঠাকুরের আসন আর তার সামনের মেঝে সজ্জিত হলো। কিন্তু সেদিকে যতবারই তাকালাম, মনে হল, শিউলি আর যেন ঠিক আগের মতো শুভ্র, পবিত্র, নিষ্কলুষ নেই।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s