🙦 বাবার লেখা জীবনস্মৃতি 🙤
খুব অস্পষ্ট দেখতে পাই নাকতলায় আমাদের বাড়ির ঠিক পাশের জমিটাতেই যে স্কুলটা রয়েছে (হ্যাঁ,কিছুটা হাত ফেরতা হলেও এখনও টিমটিম করে জ্বলছে), সেখানে আমার মেজোদাদার সঙ্গে গিয়েছি, উদ্দেশ্য ভর্তি হব। আমার তখন হয়তো বা বছর ছয়-সাত বয়স।
দেশ বিভাগের পর ছিন্নমূল উদ্বাস্তু পরিবারদের সরকার বাস্তুজমি দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছেন। এলাকার নাম নাকতলা, নামের উৎপত্তির ইতিহাস জানা নেই। বন্টিত একশো জমির মধ্যে একটি আমাদের পরিবারের বরাতে জুটেছে। একটা দৃশ্য মোটামুটি স্মৃতিতে মলিন হয়েও ভেসে আছে — আমাদের জমির একবারে লাগোয়া এক মাঝারি মাপের পুকুর। সেই পুকুরই এক সময় মাটি দিয়ে ভর্তি করে যে জমি তৈরী হলো সেখানে স্থাপনা হলো এক শিশু বিদ্যালয়। এলাকায় উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান সন্ততিদের বিনামূল্যে চতূর্থ শ্রেণী পর্য্যন্ত শিক্ষাদানের জন্য সরকারী উদ্যোগ। অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। ইংরাজী ১৯৬০ সালের কোন একটা দিনে মেজদা আমায় নিয়ে গেল সেই স্কুলে ভর্তি করতে।
নূতন এক ছাত্রের আগমনে প্রধানা শিক্ষিকা খুব আনন্দিত। মিষ্টি হেসে মেজদার হাতে ধরিয়ে দিলেন ভর্তি-ফর্ম। নিজেই জানালেন জন্ম-তারিখটা ভেবে চিন্তে লিখতে, কোন প্রামাণ্য কাগজ প্রয়োজন নেই। আগের রাতেই বাড়িতে বাবা আর মেজদার আলোচনায় স্থির হয়েছে বয়স দু-আড়াই বছর কমিয়ে লেখা হবে। একটা আশা ছিল উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা অবধি দুই-তিন বারের বেশী বাৎসরিক পরীক্ষায় ফেল করবো না। সে হিসেবে শুরুতেই দু-আড়াই বছর কমিয়ে রাখলে আখেড়ে বছর নষ্ট গায়ে লাগবে না। মেজদা ভর্তি-ফর্মে জন্ম-তারিখ লিখে দিলেন ২২শে মার্চ, ১৯৫৫ সাল। সেই হলো সরকারের খাতায় আমার জন্মদিন, যে দিনের জন্ম হয়েছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার দাখিল হওয়ার লগ্নে।
ঐ অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষিকার কথা বেশ পরিষ্কার মনে আছে। যে প্রধানা শিক্ষিকা আমায় ভর্তি নিয়েছিলেন তিনি তখন বেশ বয়স্কা। আমরা বুড়ি দিদিমনি বলে ডাকতাম। খ্রিষ্টান বিধবা। আমি পাশ করে বের হওয়ার আগেই উনি অবসর নিলেন, নূতন দায়িত্ব নিলেন নির্মলা (সেন) দিদিমনি। ওঁনার সঙ্গে কয়েকজন সহ-শিক্ষিকা ছিলেন — পারুল দিদিমনি, আরতি দিদিমনি, নিভা দিদিমনি, মন্ঞ্জু দিদিমনি।
মনে আছে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত্য আমাকে ক্লাশে বসিয়ে দিয়ে ঘরের দরজার পাশেই আমাদের বাড়ির পরিচারিকাকে দাড়িয়ে থাকতে হতো। আমি ক্লাশে বসে থাকলেও আমার চোখ দরজা থেকে সরতো না। ঐ ভদ্রমহিলা চোখের আড়াল হলেই সোজা ক্লাশ থেকে ছুটে বাড়িতে চলে আসতাম। ফের আবার আমাকে তিনি ক্লাশে দিয়ে আসতেন।
আমাদের ছোটবেলায় জন্মদিন ঘিরে আনন্দ-আয়োজন একটু স্বচ্ছল পরিবারেই সম্ভব হতো। আমরা তেমন স্বচ্ছল ছিলাম না। তা ছাড়া পাঁচ ভাই, এক বোনের জন্মদিন সামাল দেওয়া আরও সমস্যার। জন্মদিনে আয়োজন নেই, তাই জন্মদিনটাকে মনে রাখবার প্রয়োজনটাও যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো।
আমার আন্দাজ দশ বছর বয়সের সময় বড়দার একমাত্র ছেলে শান্তনুর জন্ম হয়। অপভ্রংশে সে নাম এখন হয়েছে শান্তু। শান্তুর অন্নপ্রাশন অথবা প্রথম জন্মদিনকে কেন্দ্র করে আমার একটা অনন্য অভিজ্ঞতা আছে। খুব জাঁকজমক না হলেও বড়দা-বৌদি শান্তুর সেই অন্নপ্রাশন বা জন্মদিনে একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলো। কিছু পাড়া-প্রতিবেশীকে সন্ধ্যেবেলায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেন-বাড়ি থেকে এসেছিলেন রাণীপিসি। অন্যান্য আমন্ত্রিতদের মতো তিনি শান্তুর হাতে তুলে দিলেন ওর জন্য আনা একটা উপহার। আর তারপরই বের করলেন ছোট্ট আরও একটা উপহার; আর আমাকে হতচকিত করে, বিস্ময়ে আপ্লুত করে তুলে দিলেন আমার হাতে। আমার মাকে বললেন দু’জনেই ছোট, একজন উপহার পেলে অন্যজনেরও আশা জাগে। সেই হঠাৎ করে পাওয়া উপহারের আনন্দ আজ এত বছর পরও মনে আছে। বিশেষ করে যখন আমাদের শৈশব-কৈশোরে কিছু উপহার পাওয়াটাই ছিল নিতান্ত ভাগ্যের।
শারদীয়া পূজোর গন্ধ আমরা পেতাম বাড়ির ধূলো-ময়লা, আবর্জনা সাফ-সূতরোর ভিতর দিয়ে। বর্ষার শেষে শরতের রোদ যখন ঝলমল করে উঠতো তখন আসতো আমাদের বাড়িঘরের বাৎসরিক শ্রী বদলের সময়। বাড়ির সকলে হাত লাগাতাম মা আসবার আগে সমস্ত মলিনতা দূর করতে। প্রতিটি ঘরের আসবাব, দেওয়ালে টাঙানো ছবি, ছাদে ঝুলন্ত পাখা সব ঝাড়পোঁছ হতো। ট্রাঙ্ক থেকে জামা-কাপড় বের করে ঘরের বাইরে রোদে দেওয়া হতো। সারা বছরের জমে থাকা কাগজ-পত্র দেখে অপ্রয়োজনীয় কাগজ, ঘরের দেওয়ালে ঝুলন্ত পুরনো সব ক্যালেন্ডার সব ঐ দিন দূর করা হতো।
এমনই এক operation cleaning এর সময়ে কেউ একজন ছোট্ট একটা আয়তাকার কাগজ উদ্ধার করলো। মনে হলো কোন প্রয়োজনীয় কাগজ। উপরে মা-এর নাম লেখা, কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এক পুত্রসহ discharge certificate. শিশুর জন্ম তারিখ লেখা আছে ২৯শে জুন, ১৯৫২ সাল। মা-বাবার আলাপ আলোচনা, সম্ভব-অসম্ভব সব খুঁটিয়ে চিন্তা করে বোঝা গেল আমিই সেই নবজাতক। জন্ম তারিখ ২৯শে জুন,১৯৫২ সাল।
এই হলো আমার জন্মদিনের জন্মকথা।