[বাবার লেখা সত্যি ঘটনা ]
“ট্রেনের ধাক্কায় মৃত এক পরিবারের ছয় জন” — বড় বড় হরফে সংবাদ শিরোনাম (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ই আগস্ট, ২০১৫)।
বিস্তারিত খবর পড়ে জানলাম মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের কাছে এক গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসে বিহারের এক পরিবার। দুর্ঘটনার দিন তাঁরা সবাই যাচ্ছিলেন রেল লাইনের অপর পাশে অন্য এক আত্মীয়ের বাড়ি। রেলগেট থাকা সত্বেও সেখানে লাইন পার না হয়ে রেল লাইন বরাবর হাঁটছিলেন তিন মহিলা, প্রত্যেকের কোলে শিশু; ও এক বালক। সামনেই খাল — সেই খানে রেল লাইনের নীচে পাতা আছে লোহার পাত। তার দুই পাশ ফাঁকা। সেই পাতটির উপর দিয়ে খাল পার হওয়ার সময়ে পিছন থেকে চলে আসে এন জে পি – হাওড়া শতাব্দী এক্সপ্রেস। ট্রেনের ধাক্কায় তিন মহিলা, প্রত্যেকে কোলে শিশুসহ, ছিটকে পড়েন খালের জলে এবং ঘটনাস্থলেই মারা যান ছয়জনই। শুধু বালকটি বিপদ বুঝে খালের জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করেছে।
খবরটা আমার এক ভয়ংকর স্মৃতিকে আবারও জীবন্ত করে তুললো আর সেই সঙ্গেই এক হিম শীতল রক্তের স্রোত এত বছর পরেও নিজের শিরদাঁড়ায় অনুভব করলাম। এমন শোচনীয় মৃত্যু তো আমার আর ভূপীর জীবণেও আসতে পারতো!
বছরটা ১৯৮৭-৮৮, সে বছর উত্তরবঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলায় তোর্ষা আর সঙ্কোশ নদীর অববাহিকা অঞ্চলে জয়ন্তী-কামাক্ষ্যাগুড়ি এলাকাতে ভূ-তাত্বিক মানচিত্রণের কাজ করতে গিয়েছি। সঙ্গী অনুজপ্রতিম ভূপী। দুইটি জিপ, চালকদ্বয়ের নাম তালুকদারবাবু ও চক্রবর্তীবাবু। কাজের সুবিধার জন্য উত্তরাংশের কাজ করি জয়ন্তীতে থেকে, আর দক্ষিণ অংশে কাজ করি কামাক্ষ্যাগুড়িতে থেকে। চালক তালুকদারবাবুর থেকে কাজের ব্যাপারে যে সহযোগিতা পাই অপর চালক চক্রবর্তীবাবুর কাছে তার ছিটেফোঁটাও পাই না। বাধ্য হয়েই প্রতিদিন ভূপীর সঙ্গে আলোচনা করে কাজের এলাকা এবং গন্তব্যপথ এমন ভাবে পরিকল্পনা করতে হয় যাতে দূরবর্তী এলাকায় তালুকদারবাবুকে নেওয়া যায় আর নিকটবর্তী এলাকায় চক্রবর্তীবাবু।
সেই দিন পরিকল্পনা হলো কামাক্ষ্যাগুড়ি ক্যাম্প থেকে রওনা দিয়ে রায়ডাক নদীর উপর যানবাহন চলাচলের ব্রীজ পার হয়ে নদীর অপর পাড়ে গাড়ি ও চালক ছেড়ে দেব। চালক নির্দিষ্ট সময়ে রায়ডাক নদীর উপর যেখানে রেল সেতু পার হচ্ছে সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন। আমরা পায়ে হেঁটেই দিনভর নদীর অপর পাড়ে কাজ করব। তালুকদারবাবুর গাড়ি নেওয়া হলো।
ভূপীকে নিয়ে দিনভর বিস্তীর্ণ এলাকা চষে বেড়িয়েছি। দিন শেষে ক্লান্ত শরীরে হাজির হলাম রায়ডাক নদীর উপর রেলসেতুর প্রান্তে। এখানে নদী বেশ চওড়া এবং সেতুর অনেক নীচ দিয়ে বইছে। ভূপী আর আমি রেলসেতুতে উঠেছি। আপ-ডাউন লাইনের পার্শ্ববর্তী অংশ এবং মাঝ বরাবর পুরু ইস্পাতের পাত। আমরা সেই পাত বরাবর হেঁটে চলেছি।
কিছুদূর চলবার পর দেখতে পেলাম ঐ পুরু ইস্পাতের চাদরও ক্ষয়ে গিয়ে জায়গায় জায়গায় গহ্বর, আর মরচে ধরা দুর্বল অংশ। পাতে গহ্বরের মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে অনেকটা নীচে বহমান রায়ডাক। বেখেয়ালে পাতের দুর্বল অংশে পা দিলেই সটান নদীর জলে পড়ব। অতি সন্তর্পনে চলতে হচ্ছে। ধীরে ধীরে মনকে এক ভয় গ্রাস করছে। পায়ের নীচে গহ্বর দিয়ে নদীর বহমান জল দেখেই মনে সৃষ্টি হচ্ছে বিভ্রম — সেতুটা যেন তীব্রগতিতে এক দিকে সরে যাচ্ছে, নদীর জল স্থির। সেতুর স্বাস্থ্যের হাল হকিকত না জেনেই পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া যে কত বড় ভুল হয়েছে তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি। ভয় আমাদের এমনভাবে গ্রাস করলো যে এক সময় সোজা দাঁড়িয়ে হাঁটবার অবস্থাও চলে গেল। রীতিমত চার হাত পায়ে হামাগুড়ি দিতে লাগলাম। অনেক চেষ্টায় সেতুর মাঝ বরাবর পৌছলাম।
এমন অবস্থায় ভূপী হঠাৎ পাতের উপর এক মৃদু স্পন্দন অনুভব করলো। দু’জনেই মুখ চাওয়াচায়ি করছি কারণ বুঝতে। সামনে যতদূর চোখ যায় সেখানে এমন স্পন্দনের কোন কারণ দেখলাম না। শুধু দেখলাম সেতুর শেষ এখনও বেশ কিছু দূরে।
“বিশুদা পিছনে দেখুন” — ভূপীর আতঙ্কিত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। দূরে যেখানে সব লাইন এক বিন্দুতে মিলেছে সেখানে দেখলাম আমাদের মৃত্যুদূত। সেতুর উপরে দুইজন অসহায় একে অন্যের মুখের দিকে চেয়ে রয়েছি, বহু নীচে রায়ডাকের জল। সাঁতারও জানি না। নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ইঞ্জিনের হুইশেল শুনলাম। সারা শরীর অবশ, মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবো। ইঞ্জিন আরও কাছে আসতে বোঝা গেল ভূপী যে লাইন ধরে চলছে বিপদ সে লাইনেই। আমি চিৎকার করে ওকে বললাম আমার দিকে চলে আসতে। এতটুকু সময় নষ্ট না করে ভূপী আমার কাছে সরে আসলো। এবার মৃত্যুদূতকে আরও কাছে দেখতে পেলাম- রেক ছাড়া একাকী ইন্জ্ঞিন। দুটো দেহকে টুকরো টুকরো করে নদীর জলে ফেলে দিতে সে একাই যথেষ্ট। সেতুর এ পারে রেলিঙের যত কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব সেখানে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে রইলাম। ভয়ার্ত চোখে দেখলাম দানবটা সেতু কাঁপিয়ে চলে যাচ্ছে, আর চালক তীব্র ভর্ৎসনার দৃষ্টি দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে। বেঁচে থাকবার আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছি।
চকিতে সম্বিৎ ফিরলো — আর একটুও দেরী নয় — এখনই সেতুর অপর পাড়ে পৌছতে হবে। মনের সমস্ত জোর একত্রিত করে সেই ভাঙাচোরা ইস্পাতের পাত, রেলের লাইন, কাঠের স্লিপার যেখানে যেমন পেলাম তার উপর দিয়ে প্রায় দৌড়েই রেলসেতুর অপর দিকে পৌছলাম। এতক্ষণে বিশ্বাস হলো এ যাত্রা আমরা বেঁচে ফিরেছি!
সামান্য দূরে গাছের ছাওয়ায় গাড়িতে তালুকদারবাবু নিদ্রামগ্ন।
ভুল পথে হেঁটে ঐ বিহারী পরিবারকে চরম মাশুল দিতে হয়েছে; একই অপরাধে আমরা বেঁচে ফিরেছি, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান সকলকে ভাগ করে দিচ্ছি।